প্রাচীন বাংলার সাংস্কৃতিক জীবন, মূল্যবোধ ও বিশ্বাস

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - প্রাচীন বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস | NCTB BOOK

প্রাচীন বাংলার ধর্মীয় অবস্থা:

প্রাচীন বাংলায় বৈদিক ধর্ম প্রতিষ্ঠার পূর্বে অন্য কোনো ধর্মমত প্রচলিত ছিল কি-না, সে সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না। তবে সে সময় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকেরা পূজা-অর্চনা, ভয়-ভক্তি ও সংস্কারে বিশ্বাসী ছিল। তখন দেশব্যাপী ধর্মের প্রকৃতি একই রকম ছিল না। বরং বর্ণ, শ্রেণি, কৌম, জনপদ ইত্যাদির বিভিন্নতার সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম-কর্মেও বিভিন্নতা দেখা দিয়েছিল । তদুপরি, তাদের প্রাচীন ধর্মমত, সংস্কার, পূজা-পদ্ধতি প্রভৃতি রূপান্তরিত হয়ে বৈদিক ধর্মের সঙ্গে মিলে গিয়েছে। এখনও বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে নারী জাতির মধ্যে প্রচলিত বৃক্ষপূজা, পূজা-পার্বণে আম্রপল্লব, ধানছড়া, দূর্বা, কলা, পান-সুপারি, নারকেল, ঘট, সিঁদুর প্রভৃতির ব্যবহার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকদের দান । একইভাবে মনসা পূজা, শ্মশান কালীর পূজা, বনদুর্গাপূজা, ষষ্ঠীপুজা প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানেরই পরিচয় বহন করে। খাসিয়া, মুণ্ডা, সাঁওতাল, রাজবংশী, বুনো, শবর প্রভৃতি কৌমের লোকেরা তাদের আদিম পুরুষদের মতো আজও দেবতার আসনে বসিয়ে গাছ, পাথর, পাহাড়, পশু-পাখি ও ফল-মূলের পূজা করে থাকে ।

খ্রিষ্টপূর্ব চার শতক থেকেই উপমহাদেশের তিনটি বৃহৎ ধর্ম-বৈদিক, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রভাব বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় ও চতুর্থ শতক পর্যন্ত এখানে আর্য-বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রসার লাভ করেনি। মধ্যদেশ থেকে এসে ব্রাহ্মণেরা TR. বঙ্গদেশের নানা জায়গায় বসতি স্থাপন করেছিল। এভাবে ষষ্ঠ শতকে বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির ঢেউ বাংলার সীমানা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। পাল শাসনামলেও বৈদিক ধর্মের প্রভাব-প্রতিপত্তি অটুট ছিল। বর্ম ও সেন রাজাদের প্রায় সকলেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। এই দুই বংশের রাজত্বকালে বৈদিক ধর্ম আরও প্রসার লাভ করে। তখন বৌদ্ধধর্ম অনেকখানি ম্লান হয়ে গিয়েছিল। বৈদিক যাগ-যজ্ঞে পৌরাণিক দেব-দেবী ও বিশেষ বিশেষ তিথি-নক্ষত্রে স্নান-দান-ধ্যান-ক্রিয়াকর্মের প্রচলন শুরু হয়। নামকরণ, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, গৃহপ্রবেশ ইত্যাদি সংস্কার বাঙালি ব্রাহ্মণ্য সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। 

বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বাংলার বুকে দ্রুত প্রসার লাভ করলেও কালক্রমে এর মধ্যে বিবর্তন দেখা দেয়। এ যুগে পূর্বের দেব-দেবীর পরিবর্তে নতুন নতুন দেব-দেবীর পূজা শুরু হয়। এ নতুন দেব-দেবীরা ছিলেন মূলত পুরাণ ও মহাকাব্যে বর্ণিত দেব-দেবী। তাই এ ধর্মকে ‘পৌরাণিক ধর্ম' বলা হয়। পুরোহিতরা ধর্ম-কর্ম পরিচালনা করার সার্বিক দায়িত্ব লাভ করেন। ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ডে জটিলতা বেড়ে যায়। দেবতার বেদিতে দুধ ও ঘৃত উৎসর্গের পরিবর্তে পশুবলি বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কার ধর্মের অঙ্গ হিসেবে দেখা দেয়। পৌরাণিক পূজা-পার্বণের রীতি-নীতি ও ক্রিয়াকলাপ থেকে যে সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়, সেগুলোর মধ্যে বৈষ্ণবধর্ম সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। গুপ্তযুগে শিবধর্মও প্রচলিত ছিল। এ সকল দেব-দেবীর পূজা ব্যতীত শক্তি ও সূর্যপূজা ছিল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য। উত্তরবঙ্গে জৈন সম্প্রদায়ও বিদ্যমান ছিল। প্রাচীন বাংলায় বৌদ্ধধর্ম একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। পাল রাজাদের সুদীর্ঘ চারশ' বছরের রাজত্বকালে তাঁদের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা-বিহার ছাড়িয়ে এ ধর্ম আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।

সেন যুগে বিষ্ণু, শিব, পার্বতী প্রভৃতি দেব-দেবীর পূজা শুরু হয় এবং বহু মন্দির নির্মিত হয়। ফলে বাংলায় বৌদ্ধধর্মের পতন ঘটে। সেন আমলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দাপটে বৌদ্ধধর্মের পতন ঘটে। তারপর শেষ আঘাত আসে তুর্কি মুসলমানদের নিকট থেকে । প্রাচীন বাংলায় বহু ধর্ম-সম্প্রদায়ের সহ-অবস্থান থাকলেও এদের মধ্যে কলহ ও হিংসা-দ্বেষ ছিল না। তারা পরস্পর মিলেমিশে পাশাপাশি বাস করতো। বিশেষ করে পাল রাজারা বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক হয়েও অন্যান্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এ যুগে বাংলার ধর্মীয় জীবন খুব উন্নত ছিল এবং পরধর্মসহিষ্ণুতা বাঙালি চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।

Content added || updated By
Promotion